হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ বন অস্তিত্ব সঙ্কটে বন্যপ্রাণী
এম.আর. রাজ, নওগাঁ : ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এই প্রবাদটি আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু দিন দিন এই প্রবাদটির বাস্তবিকতা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বনের সুন্দর্য্য পশু-পাখি, তারা আজ খাদ্য নিরাপত্তা, বন উজাড়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বন্যপ্রাণী রক্ষায় আইনের উপযুক্ত বাস্তবায়নের অভাবে বিলুপ্ত ও দুর্দশার শিকার হচ্ছে। গ্রামে জনবসতি স্থাপন, আবাদি জমি তৈরি, শিল্পকারখানা নির্মাণ করতে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করায় আগের মতো ঝোপঝাড়ের দেখা মেলে না। তাই শ্যামল বাংলার প্রাকৃতিক রূপ মাধুর্য ধরে রাখা গ্রামীণ বনের দেখা তেমন পাওয়া যায় না। জঙ্গল পরিষ্কার করায় দেশীয় বৃক্ষ, লতাপাতা ও বনজ ঔষধি গাছ যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে সেখানে আবাস করা বন্যপ্রাণী ও পাখি।
বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতে কালো রঙের ফিঙেরা সারা দিন পোকা ধরে খয়ে ফসলের ক্ষেতে কীটের আক্রমণ কমিয়ে রাখে। এতে কৃষকের ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার করার তেমন প্রয়োজন হয় না। এই ফিঙেদের একমাত্র আবাসস্থল প্রামীণ বন ও ঝোপঝাড়। বর্তমানে প্রামীণ বন ও ঝোপঝাড় কমে আসায় তাদের সংখ্যাও হৃাস পেয়েছে। গ্রামীণ ঝোপঝাড় কমে আসায় শুধু ফিঙেরা নয়, ক্ষেতের ইঁদুর দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নানা প্রজাতির সাপ, শিয়াল, বেজি, বড় পাখির সংখ্যাও কমে আসছে। ফলে কৃষি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন ঠিক রাখতে প্রয়োগ করা হচ্ছে কীটনাশক ও ইঁদুর মারার বিষ। আর এসব বিষ প্রয়োগের ফলে কীটপতঙ্গ বিষকৃয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছটপট করতে থাকে এ সময় আক্রান্ত কীটপতঙ্গগুলো ফিঙ্গেসহ নানা প্রজাতির পাখি খেয়ে মৃত্যুর কোলে ডলে পড়ছে। এতে একদিকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও অপর দিকে ধংস হচ্ছে প্রাণীকূল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্য প্রাণী সুস্থ ও সঠিক সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন দুর্যোগে বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য কার্যক্রম ঘোষণা করেছিলো। এছাড়াও বর্তমানে সরকার ‘সাউথ এশিয়া ওয়াইল্ডলাইফ এনফোর্সমেন্ট’ নামক একটি নেটওয়ার্কে ৮টি দেশের সাথে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও পাচার ঠেকাতে একযোগে কাজ করার কথাও ঘোষণা করেছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এইসব কার্যক্রমের সক্রিয়তা আদতে শুরু হয়েছে কিনা তা দেখা যায়নি।
মহাদেবপুর উপজেলায় বন্যপ্রাণী ও পাখি সংরক্ষণ নিয়ে দির্ঘদিন যাবৎ কর্মরত ও পুরষ্কার প্রাপ্ত গবেষক মুনছুর সরকার জানান, প্রতিটি গ্রামেই বন বা ঝোপঝাড় কমে গেছে। গ্রামে ঝোপঝাড় থাকলে বিলুপ্তপ্রায় পাখি ও বন্যপ্রাণী সেখানে আশ্রয় নেয়। সেগুলো ক্ষেতের পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। একটি ফিঙে পাখি সারা দিনে ফসলের ক্ষতিকারক অনেক পোকামাকার ধরে খায়। যেমন ফিঙের খাবার ঘাসফড়িং, হলুদ মাজরাপোকা, পাতাফড়িং, পামরি পোকা। এতে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি কীটনাশকের অতিরিক্ত খরচ থেকে রেহাই পান কৃষক। কিন্তু মানুষের মধ্যে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে আবাদ বা বিদেশি গাছ রোপণের প্রবণতা বেরে যাওয়ায় তাদের আশ্রয় নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে ওইসব প্রাণী ও পাখিগুলো দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। গ্রামীণ ঝোপঝাড় ধ্বংস হওয়ায় সেখানে থাকা বিপন্নপ্রায় পাখি ও অন্য প্রাণীগুলোর খাদ্য বা পরস্পর নির্ভরশীলতা ভেঙে পড়েছে। মারা পড়ে উপকারী প্রাণী। যে পাখি কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষকদের উপকার করত, সেই পাখি কমে আসায় কীটপতঙ্গ ও নিত্যনতুন রোগ-বালাইয়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। সেগুলো প্রতিরোধে কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োগ করতে গিয়ে কৃষকের খাদ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিষাক্ত হচ্ছে খাদ্য, কমছে পুষ্টিগুন। তিনি আরো জানান, গ্রামীণ বনে ফিঙে, শালিক, ডাহুক, ঘুকু, কেচকেচি, বক, দোয়েল, টুনটুনি, বাবুই, বুলবুলি, হুদুম পেচাসহ নানা পাখি বাস করে। সেই সাথে শিয়াল, বেজি, নানা প্রজাতির সাপ, ইঁদুর, বনবিড়াল, গুইসাপ, কচ্ছপ, গন্ধগোকূলসহ নানা প্রাণী বাস করে। যারা কৃষি পরিবেশের বস্তু সংস্থানে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও বনে পেয়ারা, খুদিজাম, লটকন, চালতা, পিশুণ্ডি, ডেউয়াসহ নানা ফল উত্পাদন হয়। আছে ঔষধি গাছও। ২০১০ সালে প্রাণী বিজ্ঞানীদের হিসাবে দেশে ১০৫৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। তার মধ্যে ৪২টি উভচর, ১৫৭ সরীসৃপ, ৭৩৬টি পাখি ও ১২৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে ৩৯০টিই কোনো না কোনোভাবে হুমকির মুখে আছে। এর মধ্যে সঙ্কটাপন্ন বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে ৩০৯ প্রজাতি। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রাণীদের মধ্যে ১৯ শতাংশই বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। মহাদেবপুর উপজেলার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়বৃদ্ধদের কাছেও জিনি গেছ মামা ও সাদা মনের মানুষ নামে পরিচিত এবং বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষনের কারনে সরকারি ভাবে পরষ্কার প্রাপ্ত সেই শামসদ্দিন মন্ডল এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, গ্রামীণ বন ধ্বংস হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতিতে এই বৈচিত্র্য-শূন্যতা বাড়তে থাকলে প্রতিটি প্রাণের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। গ্রামীণ ঝোপঝাড় ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ও জালের ব্যবহারসহ শিকারের কারণে গ্রামীণ বন্যপ্রাণী কমে যাচ্ছে। আর এসব সংরক্ষন করতে হলে অবশ্যয় সরকারের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ ঝোপ-জঙ্গল সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। উল্লেখ্য, বন্যপ্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। বন্যপ্রাণীদের রক্ষায় তাদের রয়েছে বিভিন্ন আইন ও কার্যক্রম। তাদের অধীনেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ পাস হয়েছে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম শুধুই শোনা যায় কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না। এ মন্ত্রণালয়ের আইনে রয়েছে, বন্যপ্রাণী হত্যা ও বন্দি করলে বিভিন্ন শাস্তিমূলক আইন। কিন্তু এসব আইন থাকার পরও উপযুক্ত বাস্তবায়নের অভাবে তারা বন্যপ্রাণীদের খাদ্য ও বাসস্থলের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। যা বন ও পরিবেশ মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। গত ১২ মার্চ-২০১৬ তিনি বলেছেন- ‘বন ও পরিবেশ বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়’।
এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং গাফলতির কারণে আজ বন্যভূমি উজাড় বনের সৌন্দর্য বন্যপ্রাণীরা খাবারের অভাবে লোকালয়ে এসে হাহাকার করছে, খাবার না পেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সক্রিয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং গাফলতির কারণে আজ বন্যভূমি উজাড় বনের সৌন্দর্য বন্যপ্রাণীরা খাবারের অভাবে লোকালয়ে এসে হাহাকার করছে, খাবার না পেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সক্রিয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে না।
কোন মন্তব্য নেই