হিংসের পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা : তসলিমা নাসরিন
তসলিমা নাসরিন
: কী দেখি
আমরা প্রতিদিন?
দেখি রাস্তায়
মানুষ মানুষকে
গালি দিচ্ছে,
ধমকাচ্ছে। দেখি
মানুষ মানুষকে
মারছে। পিটিয়ে
মেরে ফেলছে।
খুন করছে।
চাপাতি চালাচ্ছে।
পেটে বুকে
ছুরি বসাচ্ছে।
কেউ কেউ
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
এসব দৃশ্য
দেখছে।
কেউ আবার
দেখতে দেখতে
চলে যাচ্ছে
নিজের কাজে।
আগে হয়তো
মানুষ দৌড়ে
গিয়ে বাঁচাতে
চাইতো রাস্তায়
পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায়
কাতরাচ্ছে এমন
কাউকে। আজকাল
গা বাঁচিয়ে
চলার অভ্যেস
হয়ে গেছে।
যার যা
খুশি হোক,
আমার কিছু
না হলেই
হলো— এই
হচ্ছে মনের
কথা।
আমাদের দিন
শুরু হয়
পত্রিকা পড়ে।
কী পড়ি
আমরা? শহরে
খুন, গ্রামে
খুন। জমিজমা
নিয়ে খুন,
টাকা পয়সা
নিয়ে খুন,
রাজনীতি নিয়ে
খুন, লোভ
আর স্বার্থান্ধতার
কারণে খুন,
ভিন্ন মত
থাকার অপরাধে
খুন, ঝগড়া-লড়াই হলো,
খুন। ওর
চাল চলন
পছন্দ নয়,
বড় বাড়
বেড়েছে, সুতরাং
সুযোগ পেলে
খুন করে
দেবো ওকে।
এই তো
সমাজ আমাদের।
এই সমাজে
আমরা ঘৃণা,
হিংসে, লোভ,
অন্যায়, অত্যাচার
দেখতে অভ্যস্ত।
আমরা যা
দেখতে অভ্যস্ত
নই, তা
প্রেম ভালোবাসা।
নাটকে সিনেমায়
দেখি, কিন্তু
রাস্তাঘাটে দেখি
না। পার্কে
বা নদীর
পাড়ে প্রেম
করতে এলে
আমরা পুলিশদের
দিয়ে ওদের
পিটিয়ে বিদেয়
করি। নয়তো
সোজা নিয়ে
থানায় বন্দী
করি।
বিশাল অপরাধ
করেছে বটে,
পাশাপাশি বসে
হাতে হাত
রেখে গল্প
করছিল। ভালোবাসছিল।
কেউ কাউকে
ভালোবাসছে দেখলে
আমরা তার
নাম দিই
‘অশ্লীলতা’।
আর দুটো
ছেলে মেয়ে
চুমু খেলে?
ছি ছি
কী লজ্জা
কী লজ্জা!
মানুষ চোখ
ঢাকে অশ্লীলতার
লজ্জায়। চুমু
খাওয়া চলবে
না। চুমু
খেলে দুজনকে
পিটিয়ে বের
করে দাও
এলাকা থেকে।
জরিমানা করো।
এই হচ্ছে
বিচার।
মানুষের চোখে
বর্বরতা অশ্লীল
নয়। মানুষ
মানুষকে গালি
দিচ্ছে, ঘৃণা
ছিটোচ্ছে, হিংসে
ছুড়ে দিচ্ছে,
মানুষ মানুষকে
মারছে, কোপাচ্ছে—
এসব দৃশ্যকে
কেউ অশ্লীল
বলছে না।
দেখতে দেখতে
এখন এসবই
স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক
দৃশ্য হলো,
নারী পুরুষ
ভালোবেসে পরস্পরকে
জড়িয়ে ধরছে,
চুমু খাচ্ছে।
তাই অস্বাভাবিক
দৃশ্যের বিরুদ্ধে
ক্ষেপে ওঠে
আমাদের সুশীল
সমাজ, আমাদের
ধর্মীয় সমাজ।
প্রতি বছরের
মতো এবছরও
হিন্দু মৌলবাদী
দল বজরঙ
দল বেরিয়ে
পড়েছে ভারতের
রাস্তায়। তারা
বলছে, ‘ভালেন্টাইন
ডে হিন্দু
সংস্কৃতি নয়,
সুতরাং এই
দিবস এদেশে
পালন করা
চলবে না।
বিদেশি সংস্কৃতির
আমদানি কিছুতেই
মানবো না’। দীর্ঘ শতাব্দী
যাবৎ ভারতবর্ষে
বাস করেছে
বিদেশিরা, সে
কারণেই ভারতীয়
সংস্কৃতি বিদেশি
সংস্কৃতির সঙ্গে
মিলে মিশে
আক্ষরিক অর্থেই
একাকার।
ভাষায়, পোশাকে,
খাবারে, আসবাবে,
ধর্মে, কর্মে,
শিল্পে, সংস্কৃতিতে—
কোথায় ভারতবর্ষের
বাইরের প্রভাব
নেই? এখন
হঠাৎ করে
বিদেশি সংস্কৃতি
চলবে না
বলা বোকামো
ছাড়া আর
কিছু নয়।
মৌলবাদীরা ঘোষণা
করেছে, যদি
কোনও ছেলে
মেয়েকে তারা
আজ বাইরে
প্রেম করতে
দেখে, তাহলে
জোর করে
তাদের বিয়ে
দিয়ে দেবে।
এর মানে
তারা প্রেমিক
প্রেমিকা হিসেবে
কাউকে দেখতে
চাইছে না,
তারা রাস্তায়
বের হওয়া
নারী-পুরুষকে
শুধু স্বামী
স্ত্রী হিসেবে
দেখতে চাইছে।
মৌলবাদীরা পাবে,
ক্লাবে, রেস্তোরাঁয়
গিয়ে হুমকি
দিয়ে এসেছে,
কোনওরকম ভালেন্টাইন
ডে পার্টি
যেন না
হয়, কোনওরকম
নাচ গান
আনন্দ উল্লাস
যেন না
হয়।
মুসলিম মৌলবাদীরাও
একই সুরে
কথা বলে।
কে কার
কাছ থেকে
অসহিষ্ণুতা শিখেছে,
তা জানি
না। তবে
দু’দলই
মারমুখী, দু’দলই ভালেন্টাইন ডে’র গিফট পুড়িয়ে
দিচ্ছে। গিফটের
দোকানের ঝাঁপি
বন্ধ করে
দিচ্ছে। বলছে,
‘ভালেন্টাইন ডে
আমাদের সংস্কৃতি
নয়, এটি
উপলক্ষ করে
কোনও রকম
ব্যবসা বাণিজ্য
বরদাস্ত করা
যাবে না’।
আসলে হিন্দু
বা মুসলিম
সংস্কৃতি বলে
আলাদা কিছু
নেই। সবই
বিভিন্ন সংস্কৃতি
থেকে ধার
করা সংস্কৃতি।
নিজের আদি-সংস্কৃতিও সময়ের
সঙ্গে অনেকটাই
বদলে গেছে।
পৃথিবীর আসলে
দুটোই সংস্কৃতি।
একটি ঘৃণার,
হিংসের, কূপমণ্ডূকতার,
মূর্খতার। আরেকটি
প্রেমের, ভালোবাসার,
সৌহার্দ্যের, সহমর্মিতার।
ধর্মীয় মৌলবাদীরা,
নারীবিদ্বেষীরা, নীতি-রীতির ধ্বজাধারীরা
ঘৃণার সংস্কৃতিতে
বিশ্বাসী। আর
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সত্যিকার
শিক্ষিত আর
সচেতন মানুষ
ভালোবাসায় আর
উদারতায় বিশ্বাসী।
লড়াইটা সে
কারণেই আমি
বলি, বিভিন্ন
ধর্মের মধ্যে
নয়, লড়াইটা
আসলে চিরকালই
উদারতা আর
অনুদারতার মধ্যে,
সভ্যতা আর
বর্বরতার মধ্যে,
আধুনিকতা আর
অর্বাচীনতার মধ্যে,
স্বাধীনতা আর
পরাধীনতার মধ্যে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি
ভ্যালেন্টাইন ডে
পালন করি
না। ভালোবাসা,
আমি মনে
করি না
একটি দিনের
উৎসব। ভালোবাসা
প্রতিদিন উত্যাপনের
জিনিস। প্রেম
প্রতিদিনের। কিন্তু
কেউ যদি
দিনটিতে কাউকে
একটু বেশি
ভালোবাসতে চায়,
মোড়ে দাঁড়িয়ে
কাউকে চুমু
খেতে চায়,
ভালোবাসায় বুঁদ
হয়ে থাকতে
চায় সারাদিন,
তবে তাকে
আমি বাধা
দিই না।
বাধা দিই
না, কারণ
আমি ব্যক্তি
স্বাধীনতায় বিশ্বাস
করি।
সবাইকে আমি
যা বিশ্বাস
করি তাতে
বিশ্বাস করতে
হবে কেন?
আমি পাহাড়ে
উঠতে পছন্দ
করি না,
কিন্তু কেউ
পাহাড়ে উঠতে
চাইলে উঠতে
দিই। আমি
হিজাব পরি
না, কেউ
পরতে চাইলে
আপত্তি করি
না। আমি
নাইটক্লাবে গিয়ে
নাচতে পছন্দ
করি না,
কিন্তু কেউ
যদি পছন্দ
করে তাকে
বলি নাচতে।
আমি ধর্ম
পালন করি
না, কিন্তু
যারা ধর্ম
পালন করে,
তাদের ধর্ম
পালনে আমি
বাধা দিই
না। তারা
বাধাপ্রাপ্ত হলে
বরং আমি
তাদের ধর্ম
পালনের অধিকারের
পক্ষে সবার
আগে দাঁড়াই।
তবে ধর্মের
নামে, সংস্কৃতির
নামে, জাতীয়তার
নামে অন্যের
স্বাধীনতাকে নষ্ট
করা, অন্যকে
নির্যাতন করা,
ভায়োলেন্স করা—
এসবের ঘোর
বিরোধী আমি।
পৃথিবীতে লোভ
আর হিংসের
মহোৎসব হয়,
কেউ বিশেষ
আপত্তি করে
না, বরং
অধিকাংশ মানুষই
মুগ্ধ চোখে
সেসব দেখে।
সিনেমায় মারামারি
হয়, খুনোখুনি
হয়, দেখে
উচ্ছ্বসিত হয়
মানুষ। পারমাণবিক
বোমা বানানোয়
মেতে ওঠে
দেশ। অস্ত্র
তৈরিতে মাতে।
অস্ত্র বিক্রির
প্রতিযোগিতা চলে।
যুদ্ধ লেগে
থাকে। খেলনা-অস্ত্র হাতে
দিয়ে শিশুদের
শান্ত করা
শেখাচ্ছে প্রাপ্ত-বয়স্করা।
এই পৃথিবীতে
যদি সত্যিকার
ভালোবাসা বলতে
কিছু থাকে,
তবে এর
চেয়ে বড়
সুসংবাদ আর
কিছু আপাতত
নেই। মানুষ
কেন মানুষকে
গোপনে ভালোবাসবে?
আলিঙ্গনের চেয়ে,
চুম্বনের চেয়ে
মধুর দৃশ্য
মানবসমাজে আর
নেই। মানুষের
জন্য ফেলা
মানুষের চোখের
জল পৃথিবীর
সব জলের
চেয়ে পবিত্র।
মানুষের শুভ
কামনায় মানুষের
হাসি, সবচেয়ে
পবিত্র হাসি।
মানুষ প্রকাশ্যে
ভালোবাসুক। প্রকাশ্যে
প্রেম করুক।
অন্যরা দেখুক।
যারা ভালোবাসতে
শেখেনি, তারা
শিখুক। ঘৃণা
দূর হোক।
অসন্তোষ, অসহিষ্ণুতা,
অশান্তি দূর
হোক। ভালোবাসার
উৎসব হোক।
একদিন নয়।
প্রতিদিন। এই
প্রজাতিকে টিকিয়ে
রাখতে হলে,
পরস্পরের প্রতি
ঘৃণা নয়,
প্রয়োজন ভালোবাসার।
ঘৃণা আর
স্বার্থপরতা প্রজাতিকে
বিলুপ্ত করবে।
একে বাঁচিয়ে
রাখবে নিখাদ
ভালোবাসা, সহমর্মিতা।
চারদিকে দেখি
ভালোবাসা ক্রমশ
বিলুপ্ত হচ্ছে,
ঘৃণা হচ্ছে
শক্তিশালী।
এই স্রোতের
বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে
হবে আমাদের,
আমরা যারা
ভালোবাসি। ঘৃণা
যেমন সংক্রামক।
ভালোবাসাও সংক্রামক।
ভালোবাসাই ভালোবাসতে
উদ্বুদ্ধ করে।
ভালোবাসা দিলে
ভালোবাসা মেলে।
ভালোবাসা শুধু
মানুষকে নয়,
পৃথিবীকে বদলে
দিতে পারে।
ঘৃণার ক্ষমতা
অসীম জানি,
ভালোবাসার ক্ষমতা
অসীমের চেয়েও
অসীম। বিডি
প্রতিদিন
কোন মন্তব্য নেই